জীবন ও বৃক্ষ

জীবন ও বৃক্ষ

মোতাহের হোসেন চৌধুরী


লেখক: মোতাহের হোসেন চৌধুরী।

জন্ম:  ১৯০৩ খিষ্টাব্দ।

জন্মস্থান: বর্তমান লক্ষ্মীপুর জেলার কাঞ্চনপুর গ্রাম।

পিতা:   সৈয়দ আবদুল মজিদ।

মাতা:  ফাতেমা খাতুন।

শিক্ষাজীবন : কুমিল্লা ইউসুফ হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক; কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে আইএ ও বিএ পাস করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাইভেট পরীক্ষার্থী হিসেবে বাংলায় এমএ পাস করেন (১৯৪৩)।

পেশা: কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে লেকচারার পদে যোগদান (১৯৪৬); দেশবিভাগের পর চট্টগ্রাম কলেজে যোগদান (১৯৪৭-১৯৫৬)। 

বিশেষ অবদান : ‘বুদ্ধির মুক্তির আন্দোলন’-এর সাথে যুক্ত ছিলেন। ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজের’ সাথে ঘনিষ্ঠ যোগ ছিল। সাহিত্যের অঙ্গনে ও বাস্তব জীবনে উভয় ক্ষেত্রেই তিনি ছিলেন সৌন্দর্যবোধ, মুক্তবুদ্ধি-চেতনা ও মানবপ্রেমের আদর্শের অনুসারী। তিনি ছিলেন কাজী আবদুল ওদুদ, আবুল হুসেন, কাজী মোতাহার হোসেন, আবুল ফজল, আবদুল কাদির প্রমুখের সহযোগী। মননশীল, চিন্তা-উদ্দীপক ও পরিশীলত গদ্যের রচয়িতা হিসেবে বাংলাদেশের লেখকদের মধ্যে তিনি বিশিষ্ট হয়ে আছেন।

সাহিত্যকর্ম

প্রবন্ধ: সংস্কৃতি কথা।                                                                                                                                                                                                                                       

অনুবাদগ্রন্থ: ‘সভ্যতা’ (ক্লাইভ বেল এর "Civilization" গ্রন্থের অনুবাদ), ‘সুখ’ (বারট্রান্ড রাসেলের "Conquest of Happiness"  গ্রন্থের অনুবাদ)

মৃত্যু ১৮ই সেপ্টম্বর, ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দ, চট্টগ্রাম।

লেখক সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য

আন্দোলনের সাথে যুক্ত: তিনি বাঙালি মুসলমান সমাজের অগ্রগতির আন্দোলন ‘বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন’- এর একজন সহযোগী ছিলেন।

সাহিত্যিক প্রভাব: তাঁর রচনাশৈলীতে প্রমথ চৌধুরীর গদ্যশৈলী এবং মননে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রভাব লক্ষ করা যায়।   

মূল কাজ ও দর্শন: 

চিন্তা ও বিষয়বস্তু: তিনি মানুষের মৌলিক বিষয়, বিশেষ করে মানবজীবনকে কীভাবে সুন্দর ও সংস্কৃতিবান করা যায়, তা নিয়ে ভেবেছেন।                                                                                             

‘সংস্কৃতি কথা’ গ্রন্থ: তাঁর প্রধান প্রবন্ধ গ্রন্থ ‘সংস্কৃতি কথা’ ১৯৫৮ সালে প্রকাশিত হয় এবং এই বইতে তিনি সংস্কৃতি ও মানুষের বেঁচে থাকার সম্পর্ক নিয়ে গভীর আলোচনা করেছেন।                             

‘শিক্ষা ও মনুষ্যত্ব’ প্রবন্ধ: এই প্রবন্ধে তিনি শিক্ষা ও মনুষ্যত্বের মধ্যে গভীর সম্পর্ক দেখিয়েছেন এবং শিক্ষার মাধ্যমে মানবসত্তার বিকাশকে গুরুত্ব দিয়েছেন।                                                 

উল্লেখযোগ্য উক্তি: ‘ধর্ম সাধারণ লোকের কালচার, আর কালচার শিক্ষিত মার্জিত লোকের ধর্ম’- এটি তাঁর একটি বিখ্যাত উক্তি।

উৎস পরিচিতি

মোতাহের হোসেন চৌধুরীর ‘জীবন ও বৃক্ষ' প্রবন্ধটি তাঁর ‘সংস্কৃতি-কথা’ গ্রন্থ থেকে সংকলিত হয়েছে।



মূলপাঠ

সমাজের কাজ কেবল টিকে থাকার সুবিধা দেওয়া নয়, মানুষকে বড় করে তোলা, বিকশিত জীবনের জন্য মানুষের জীবনে আগ্রহ জাগিয়ে দেওয়া। 🔒ব্যাখ্যাস্বল্পপ্রাণ স্থূলবুদ্ধিজবরদস্তিপ্রিয় মানুষে সংসার পরিপূর্ণ।🔒ব্যাখ্যা তাদের কাজ নিজের জীবনকে সার্থক ও সুন্দর করে তোলা নয়, অপরের সার্থকতার পথে অন্তরায় সৃষ্টি করা। প্রেম ও সৌন্দর্যের স্পর্শ লাভ করেনি বলে এরা নিষ্ঠুর ও বিকৃতবুদ্ধি🔒ব্যাখ্যা এদের একমাত্র দেবতা অহংকার।🔒ব্যাখ্যা তারই চরণে তারা নিবেদিতপ্রাণ। ব্যক্তিগত অহংকার, পারিবারিক অহংকার, জাতিগত অহংকার- এ সবের নিশান ওড়ানোই এদের কাজ। মাঝে মাঝে মানবপ্রেমের কথাও তারা বলে। কিন্তু তাতে নেশা ধরে না, মনে হয় আন্তরিকতাশূন্য, উপলব্ধিহীন বুলি🔒ব্যাখ্যা


এদের স্থানে এনে দিতে হবে বড় মানুষ-🔒ব্যাখ্যা সূক্ষ্মবুদ্ধি উদারহৃদয় গভীরচিত্ত ব্যক্তি, যাদের কাছে বড় হয়ে উঠবে জীবনের বিকাশ, কেবল টিকে থাকা নয়। তাদের কাছে জীবনাদর্শের প্রতীক হবে প্রাণহীন ছাঁচ বা কল নয়, সজীব বৃক্ষ- যার বৃদ্ধি আছে, গতি আছে, বিকাশ আছে, ফুলে ফলে পরিপূর্ণ হয়ে অপরের সেবার জন্য প্রস্তুত হওয়া যার কাজ। বৃক্ষের জীবনের গতি ও বিকাশকে উপলব্ধি করা দরকার, নইলে সার্থকতা ও পরিপূর্ণতার ছবি চোখের সামনে ফুটিয়ে তোলা সম্ভব হবে না।


বৃক্ষের দিকে তাকালে জীবনের তাৎপর্য উপলব্ধি সহজ হয়।🔒ব্যাখ্যা তাই, বারবার সেদিকে তাকানো প্রয়োজন। মাটির রস টেনে নিয়ে নিজেকে মোটাসোটা করে তোলাতেই বৃক্ষের কাজের সমাপ্তি নয়। তাকে ফুল ফোটাতে হয়, ফল ধরাতে হয়। নইলে তার জীবন অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। তাই বৃক্ষকে সার্থকতার প্রতীক হিসেবে গ্রহণ করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। সজীবতা ও সার্থকতার এমন জীবন্ত দৃষ্টান্ত আর নেই।


অবশ্য রবীন্দ্রনাথ অন্য কথা বলেছেন। ফুলের ফোটা আর নদীর গতির সঙ্গে তুলনা করে তিনি নদীর গতির মধ্যেই মনুষ্যত্বের সাদৃশ্য দেখতে পেয়েছেন। তাঁর মনে মনুষ্যত্বের বেদনা নদীর গতিতেই উপলব্ধ হয়, ফুলের ফোটায় নয়। ফুলের ফোটা সহজ, নদীর গতি সহজ নয়-🔒ব্যাখ্যা তাকে অনেক বাধা ডিঙানোর দুঃখ পেতে হয়। কিন্তু ফুলের ফোটার দিকে না তাকিয়ে বৃক্ষের ফুল ফোটানোর দিকে তাকালে বোধহয় রবীন্দ্রনাথ ভালো করতেন। তপোবন প্রেমিক রবীন্দ্রনাথ কেন যে তা করলেন না বোঝা মুশকিল।🔒ব্যাখ্যা

জানি, বলা হবে : নদীর গতিতে মনুষ্যত্বের দুঃখ যতটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে বৃক্ষের ফুল ফোটানোয় তা তত স্পষ্ট হয়ে ওঠে না। তাই কবি নদীকেই মনুষ্যত্বের প্রতীক করতে চেয়েছেন। 🔒ব্যাখ্যা


উত্তরে বলব : চর্মচক্ষুকে বড় না করে কল্পনা ও অনুভূতির চক্ষুকে বড় করে তুললে বৃক্ষের বেদনাও সহজে উপলব্ধি করা যায়।🔒ব্যাখ্যা আর বৃক্ষের সাধনায় যেমন একটা ধীরস্থির ভাব দেখতে পাওয়া যায়, মানুষের সাধনায়ও তেমনি একটা ধীরস্থির ভাব দেখতে পাওয়া যায়, আর এটাই হওয়া উচিত নয় কি? অনবরত ধেয়ে চলা মানুষের সাধনা হওয়া উচিত নয়।🔒ব্যাখ্যা যাকে বলা হয় গোপন ও নীরব সাধনা তা বৃক্ষেই অভিব্যক্ত, নদীতে নয়।🔒ব্যাখ্যা তাছাড়া বৃক্ষের সার্থকতার ছবি যত সহজে উপলব্ধি করতে পারি, নদীর সার্থকতার ছবি তত সহজে উপলব্ধি করা যায় না। নদী সাগরে পতিত হয় সত্য, কিন্তু তার ছবি আমরা প্রত্যহ দেখতে পাই না। বৃক্ষের ফুল ফোটানো ও ফল ধরানোর ছবি কিন্তু প্রত্যহ চোখে পড়ে। দোরের কাছে দাঁড়িয়ে থেকে সে অনবরত নতি, শান্তি ও সেবার বাণী প্রচার করে।


সাধনার ব্যাপারে প্রাপ্তি একটা বড় জিনিস।🔒ব্যাখ্যা নদীর সাগরে পতিত হওয়ায় সেই প্রাপ্তি স্পষ্ট হয়ে ওঠে না। সে তো প্রাপ্তি নয়, আত্মবিসর্জন। অপরপক্ষে বৃক্ষের প্রাপ্তি চোখের সামনে ছবি হয়ে ফুটে ওঠে। ফুলে ফলে যখন সে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে তখন আপনা থেকেই বলতে ইচ্ছা হয় : এই তো সাধনার সার্থকতা। বৃক্ষে প্রাপ্তি ও দান এক হয়ে গেছে। ফুল ও ফল একই সঙ্গে তার প্রাপ্তি ও দান। সৃজনশীল মানুষেরও🔒ব্যাখ্যা প্রাপ্তি ও দানে পার্থক্য দেখা যায় না।🔒ব্যাখ্যা যা তার প্রাপ্তি তা-ই তার দান৷🔒ব্যাখ্যা 


বৃক্ষের পানে তাকিয়ে রবীন্দ্রনাথ নিশ্চয়ই অন্তরের সৃষ্টিধর্ম উপলব্ধি করেছেন। বহু কবিতায় তার পরিচয় পাওয়া যায়। কিন্তু গদ্যে তিনি তা স্পষ্ট করে বলেননি। বললে ভালো হতো। তাহলে নিজের ঘরের কাছেই যে সার্থকতার প্রতীক রয়েছে, সে সম্বন্ধে আমরা সচেতন হতে পারতাম। 


নীরব ভাষায় বৃক্ষ আমাদের সার্থকতার গান গেয়ে শোনায়। অনুভূতির কান দিয়ে সে গান শুনতে হবে। তাহলে বুঝতে পারা যাবে জীবনের মানে বৃদ্ধি, ধর্মের মানেও তাই। প্রকৃতির যে ধর্ম মানুষের সে ধর্ম; পার্থক্য কেবল তরুলতা ও জীবজন্তুর বৃদ্ধির ওপর তাদের নিজেদের কোনো হাত নেই, মানুষের বৃদ্ধির ওপরে তার নিজের হাত রয়েছে। আর এখানেই মানুষের মর্যাদা। মানুষের বৃদ্ধি কেবল দৈহিক নয়, আত্মিকও।🔒ব্যাখ্যা মানুষকে আত্মা সৃষ্টি করে নিতে হয়,🔒ব্যাখ্যা তা তৈরি পাওয়া যায় না। সুখ-দুঃখ-বেদনা উপলব্ধির ফলে অন্তরের যে পরিপক্বতা, তাই তো আত্মা। এই আত্মারূপ ফল স্রষ্টার উপভোগ্য। তাই মহাকবির মুখে শুনতে পাওয়া যায় : ‘Ripeness is all'- পরিপক্বতাই সব।🔒ব্যাখ্যা আত্মাকে 🔒ব্যাখ্যামধুর ও পুষ্ট করে গড়ে তুলতে হবে। নইলে তা স্রষ্টার উপভোগের উপযুক্ত হবে না। বিচিত্র অভিজ্ঞতা, প্রচুর প্রেম ও গভীর অনুভূতির দ্বারা আত্মার পরিপুষ্টি ও মাধুর্য সম্পাদন সম্ভব। তাই তাদের সাধনাই মানুষের শিক্ষার প্রধান বিষয়বস্তু। বস্তুজিজ্ঞাসা তথা বিজ্ঞান কখনো শিক্ষার প্রধান বিষয়বস্তু হতে পারে না। কেননা, তাতে আত্মার উন্নতি হয় না- জীবনবোধ ও মূল্যবোধে অন্তর পরিপূর্ণ হয় না; তা হয় সাহিত্য-শিল্পকলার দ্বারা। তাই শিক্ষাক্ষেত্রে তাদের এত মূল্য।🔒ব্যাখ্যা


ওপরে যে বৃদ্ধির কথা বলা হলো বৃক্ষের জীবন তার চমৎকার নিদর্শন। বৃক্ষের অঙ্কুরিত হওয়া থেকে ফলবান হওয়া পর্যন্ত সেখানে কেবলই বৃদ্ধির ইতিহাস। বৃক্ষের পানে তাকিয়ে আমরা লাভবান হতে পারি— জীবনের গূঢ় অর্থ সম্বন্ধে সচেতন হতে পারি বলে।🔒ব্যাখ্যা


বৃক্ষ যে কেবল বৃদ্ধির ইশারা🔒ব্যাখ্যা তা নয়- প্রশান্তিরও ইঙ্গিত। অতি শান্ত ও সহিষ্ণুতায় সে জীবনের গুরুভার বহন করে।🔒ব্যাখ্যা

উত্তর : সাধনার ব্যাপারে বড় জিনিস হচ্ছে প্রাপ্তি।

উত্তর : নদীকে মনুষ্যত্বের প্রতীক বলেছেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

উত্তর : ‘জীবন ও বৃক্ষ’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে ‘তপোবন প্রেমিক’ বলা হয়েছে।

উত্তর : অনুভূতির কান দিয়ে বৃক্ষের গান শুনতে হবে।


উত্তর : নদীকে মনুষ্যত্বের প্রতীক বলেছেন বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। 

উত্তর : ‘তপোবন প্রেমিক’ হলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ।

উত্তর : তপোবন প্রেমিক। 

উত্তর : কল্পনা ও অনুভূতির চক্ষুকে বড় করে তুলে।

উত্তর : স্রষ্টার।


উত্তর : “মানুষের বৃদ্ধি কেবল দৈহিক নয়, আত্মিকও।”- বলতে মানুষের দৈহিক বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে আত্মিক বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তাকে বোঝানো হয়েছে।

সাধারণভাবে আত্মার বৃদ্ধি বলতে মানুষের মানসিক অবস্থা ও আত্মিক উন্নতিকে বোঝায়। শারীরিকভাবে মানুষের বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মানসিক অবস্থারও উন্নতি ঘটাতে হয়। আত্মার বৃদ্ধির জন্য মানুষকে আত্মা সৃষ্টি করে নিতে হয়। কারণ তা তৈরি পাওয়া যায় না। আত্মা হচ্ছে সুখ-দুঃখ-বেদনা উপলব্ধির ফলে অন্তরের পরিপক্বতা। বিচিত্র অভিজ্ঞতা ও গভীর অনুভবের মাধ্যমেই মানুষের আত্মার শ্রীবৃদ্ধি হয়। আর তা হলেই একজন মানুষ পরিপূর্ণতা অর্জন করে। এ কারণেই বলা হয়েছে, মানুষের বৃদ্ধি কেবল দৈহিক নয়, আত্মিকও।


উত্তর : প্রশ্নোক্ত উক্তিটিতে প্রকাশ পেয়েছে বৃক্ষ যা অর্জন করে তা অপরের কল্যাণে দান করে।

উক্তিটির মধ্য দিয়ে বৃক্ষের জীবনচক্র তথা মানবকল্যাণে বৃক্ষের আত্মনিবেদন সম্পর্কে বলা হয়েছে। বৃক্ষের ফুল-ফলে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠা তার প্রাপ্তি। বৃক্ষের এ প্রাপ্তি চোখের সামনে ছবির মতো ফুটে ওঠে। আবার বৃক্ষ তার এ প্রাপ্তি মানুষের কল্যাণে নিবেদন করে। সৃজনশীল মানুষের সাধনাও একই রকম। এ কারণেই বলা হয়েছে, “যা তার প্রাপ্তি তাই তার দান।”


উত্তর : বৃক্ষ তার সমস্ত অর্জন অন্যকে দান করার মধ্য দিয়ে নীরব ভাষায় আমাদের সার্থকতার গান শোনায় । 

বৃক্ষের জন্ম, বৃদ্ধি, ফুল ফোটানো, ফল ধারণ, ছায়া ও সৌন্দর্যদানÍ সবকিছুতেই যেন একটা নীরব সাধনা চলে। সব কষ্ট সহ্য করে নিজেকে অন্যের কল্যাণে উৎসর্গ করে। বৃক্ষের এ সেবাদান ও সার্থকতা নীরবেই সাধিত হয়। পরোপকারী ব্যক্তিরাও বৃক্ষের মতো নিজেদেরকে মানবকল্যাণে নিয়োজিত করেন। তাই বলা যায় যে, বৃক্ষ তার সমস্ত অর্জন নীরবে অন্যকে দান করার মধ্য- দিয়ে আমাদের সার্থকতার গান শোনায়।


উত্তর : “সাধনার ব্যাপারে প্রাপ্তি একটা বড় জিনিস।”- উক্তিটিতে যে সাধনায় প্রাপ্তি নেই সেই সাধনার কোনো সার্থকতা থাকে না- লেখক এখানে এটাই বোঝাতে চেয়েছেন।

সাগরে নদীর পতিত হওয়াকে লেখক আত্মবিসর্জন বলেছেন। এ ঘটনার মধ্যে কোনো প্রাপ্তি নেই। কিন্তু বৃক্ষের প্রাপ্তি চোখের সামনে দেখা যায়। ফলধারণের মাধ্যমেই বৃক্ষের প্রাপ্তি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। লেখকের মতে যে সাধনায় প্রাপ্তি নেই সেই সাধনা অর্থহীন। প্রাপ্তিতেই মূলত সাধনার সার্থকতা। তাই লেখক বলেছেন, সাধনার ব্যাপারে প্রাপ্তি একটা বড় জিনিস।


উত্তর : “অনবরত ধেয়ে চলা মানুষের সাধনা হওয়া উচিত নয় ।”- এ উক্তিটিতে বোঝানো হয়েছে যে, এভাবে মানুষ তার সঠিক গন্তব্য চিনে নিতে পারে না।

লক্ষ্য নির্ধারণ করে ধীরে ধীরে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া উচিত । মানুষকে এমনভাবে চলা উচিত যাতে তার এগিয়ে যাওয়ার পথে কোনো ক্ষতি সাধিত না হয়। অনবরত ধেয়ে চলতে গেলে পেছনে ফিরে তাকানোর সুযোগ থাকে না। তাছাড়া অনবরত ধেয়ে চলতে গেলে পথভ্রষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে কয়েক গুণ। তাই আমাদের সবার উচিত গন্তব্য বা লক্ষ্য নির্ধারণ করে ধীরে ধীরে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া।



উত্তর : মানুষের জন্য সমাজের কাজ হলো টিকিয়ে রাখার  পাশাপাশি বড় করে তোলা এবং বিকশিত জীবনের আগ্রহ জাগিয়ে দেওয়া।
মানুষ পৃথিবীতে আর দশটি প্রাণীর মতো নয়। তাকে বিকশিত জীবনে উত্তীর্ণ করতে সমাজের অনেক রকম দায়বদ্ধতা রয়েছে। অনুকূল পরিবেশ ব্যতিরেকে মানুষ মানুষের মতো মার্জিত ও পরিশীলিত হয়ে উঠতে পারে না। মানুষকে বাইরে থেকে ও ভেতর থেকে মানুষ হওয়ার জন্য পরিবেশ সৃষ্টি করা সমাজের বড় কাজ।


উত্তর : সমাজ মানুষের ভিতর সুপ্ত গুণাবলিকে জাগ্রত হওয়ার সুযোগ দিয়ে বিকশিত জীবনের জন্য মানুষের মনে আগ্রহ জাগাতে পারে।
সমাজের কাজ কেবল টিকে থাকার সুবিধা দেওয়া নয়, মানুষকে বড় করে তোলাও সমাজের কাজ। মানুষের অন্তরাত্মাকে জাগিয়ে তোলার জন্য সমাজকে হতে হয় উদার। বদ্ধ, গুমোট, ত্রুটিপূর্ণ সমাজব্যবস্থায় মানুষ পরিপূর্ণভাবে বিকশিত হতে পারে না।


উত্তর : স্বল্পপ্রাণ স্থুলবুদ্ধি ও জবরদস্তিপ্রিয় বলতে অবিকশিত মানুষ বোঝায়।
সমাজে এমন কিছু মানুষ আছে যারা সব সময় অন্যের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে। তাদের ঈর্ষান্বিত মনোভাব সব সময় অন্যের সুখের অন্তরায় হয়। অহমিকায় পরিপূর্ণ এসকল মানুষ নিতান্তই স্থূলবুদ্ধিসম্পন্ন। তারা অন্যের ভালো সহ্য করতে পারে না। এজন্যই পরের সার্থকতার পথে অন্তরায় সৃষ্টি করে। আর এসব স্থূলবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ অত্যন্ত সংকীর্ণমনা প্রকৃতির হয়ে থাকে। নিজের জীবনের ভালোর চেয়ে তারা অন্যের জীবনের অনিষ্ট চিন্তাই সব সময় করে থাকে। কখানো কখনো জবরদস্তি করে, হুমকি-ধমকি দিয়ে স্বার্থ উদ্ধার করে। নিজেদের মানসিক বিকাশের জন্য এসব স্থুলবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ কোনো কাজই করে না। আর তাদের দ্বারাই সংসার আজ পরিপূর্ণ।


উত্তর : প্রেম ও সৌন্দর্যের স্পর্শ লাভ করেনি বলে অবিকশিত মানুষেরা নিষ্ঠুর ও বিকৃতবুদ্ধির অধিকারী।
প্রেম ও সৌন্দর্যের স্পর্শ মানুষের মনকে কোমল করে অন্তরের শুভচিন্তা ও চেতনাকে জাগিয়ে তোলে। তা হলেই মানুষ জীবনের তাৎপর্য উপলব্ধি করতে পারে। যাদের হৃদয়ে প্রেম ও সৌন্দর্যের পরশ লাগেনি তারা হয়ে পড়ে স্বল্পপ্রাণ, স্থূলবুদ্ধি ও জবরদস্তিপ্রিয়। তখন তাদের মনে আর কোনো কোমলতা থাকে না; থাকে শুধু অবিবেচনা, নিষ্ঠুরতা ও বিকৃতবুদ্ধি।


উত্তর : “এদের একমাত্র দেবতা অহংকার।”- এ কথাটি দ্বারা লেখক স্বল্পপ্রাণ, স্থূলবুদ্ধিসম্পন্ন ও জবরদস্তিপ্রিয় মানুষকে বুঝিয়েছেন।
স্বল্পপ্রাণ, স্থূলবুদ্ধিসম্পন্ন, জবরদস্তিপ্রিয় মানুষের কাজ হলো অন্যের সার্থকতার পথে বাধার সৃষ্টি করা। প্রেম ও সৌন্দর্যের স্পর্শ লাভ না করার কারণে এরা নিষ্ঠুর এবং বিকৃতবুদ্ধিতে আচ্ছন্ন এরা ব্যক্তিগত অহংকার, পারিবারিক অহংকার, জাগতিক অহংকারে এরা পরিপূর্ণ। তাই লেখক বলেছেন এ ধরনের মানুষের একমাত্র দেবতা অহংকার।



Score Board

১) গোপন ও নীরব সাধনা কার মধ্যে অভিব্যক্ত?   [ঢ.বো.১৯]

২) স্বল্পপ্রাণ, স্থুলবুদ্ধি ও জবরদস্তিপ্রিয় মানুষে পরিপূর্ণ-  [রা.বো. ১৯, চ.বো.১৭]

৩) ‘জীবন ও বৃক্ষ’ প্রবন্ধের ¯ স্রষ্টার উপভোগ্য কী?  [সি.বো.১৯]

৪) ‘জীবন ও বৃক্ষ’ প্রবন্ধে কোন বৃদ্ধি মানুষকে অন্য প্রাণী থেকে  আলাদা করেছে?  [চ.বো.১৯]

৫) ‘সজীবতা ও সার্থকতা’ জীবন্ত দৃষ্টান্ত হিসেবে কীসের উল্লেখ রয়েছে? [সি.বো.১৯]


Score Board

১) মোতাহের হোসেন চৌধুরী বৃক্ষের জীবনের কোন দুটি জিনিস উপলদ্ধি করার পক্ষপাতী?

২) বৃক্ষ বৃদ্ধি ছাড়াও আর কীসের ইঙ্গিত বহন করে?

৩) ‘জীবন ও বৃক্ষ’ প্রবন্ধের বক্তব্য অনুযায়ী যারা প্রেম ও সৌন্দর্যের স্পর্শ লাভ করেনি তাদের একমাত্র দেবতা কে?

৪) স্বল্পপ্রাণ, স্থূলবুদ্ধি  ও জবরদস্তিপ্রিয় মানুষে কোনটি পরিপূর্ণ?

৫) নীরব ভাষায় বৃক্ষ আমাদের কীসের গান শোনায়?

Score Board

উত্তর : ক) সাধনার ব্যাপারে বড় জিনিস হচ্ছে প্রাপ্তি।

খ) “মানুষের বৃদ্ধি কেবল দৈহিক নয়, আত্মিকও।”- বলতে মানুষের দৈহিক বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে আত্মিক বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তাকে বোঝানো হয়েছে।

সাধারণভাবে আত্মার বৃদ্ধি বলতে মানুষের মানসিক অবস্থা ও আত্মিক উন্নতিকে বোঝায়। শারীরিকভাবে মানুষের বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মানসিক অবস্থারও উন্নতি ঘটাতে হয়। আত্মার বৃদ্ধির জন্য মানুষকে আত্মা সৃষ্টি করে নিতে হয়। কারণ তা তৈরি পাওয়া যায় না। আত্মা হচ্ছে সুখ-দুঃখ-বেদনা উপলব্ধির ফলে অন্তরের পরিপক্বতা। বিচিত্র অভিজ্ঞতা ও গভীর অনুভবের মাধ্যমেই মানুষের আত্মার শ্রীবৃদ্ধি হয়। আর তা হলেই একজন মানুষ পরিপূর্ণতা অর্জন করে। এ কারণেই বলা হয়েছে, মানুষের বৃদ্ধি কেবল দৈহিক নয়, আত্মিকও।

গ) উদ্দীপকের ডাক্তার মনিরুলের চেতনার সঙ্গে ‘জীবন ও বৃক্ষ' প্রবন্ধের বৃক্ষের অন্যকে সবকিছু দান করে সার্থকতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হওয়ার দিকটি বৈসাদৃশ্যপূর্ণ। 

বৃক্ষ ফুলে-ফলে পরিপূর্ণতা অর্জন করে নিজেকে অন্যের কল্যাণে নিবেদন করে। অন্যের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করাতেই জীবনের চরম সার্থকতা। এ শিক্ষা আমাদের সবার মধ্যে থাকলে পৃথিবী আরও প্রেমময় ও শান্তিপূর্ণ হয়ে উঠত। 

উদ্দীপকের মনিরুল একজন স্বার্থপর ও আত্মকেন্দ্রিক মানুষ। সে ডাক্তার হয়েও রোগীর সেবা না করে সেটাকে ব্যাবসা হিসেবে নিয়েছে এবং প্রচুর অর্থ-বিত্তের মালিক হয়েছে। তার এ হীন স্বার্থপরতার বিষয়টি “জীবন ও বৃক্ষ' প্রবন্ধে অন্যের সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করার মধ্যে জীবনের সার্থকতা খুঁজে পাওয়ার বিষয়টির সঙ্গে বৈসাদৃশ্যপূর্ণ । কারণ বৃক্ষ নীরবে সার্থকতার গান শোনায়; সে ফুল-ফল ফলিয়ে মানুষের সেবা করে। নিজেকে মোটাসোটা করলেই তার কাজের সমাপ্তি হয় না। প্রবন্ধের এ দিকটির সঙ্গে ডাক্তার মনিরুলের চেতনার বৈসাদৃশ্য রয়েছে।

ঘ) “উদ্দীপকের শহীদুলের ‘ব্রত' এবং ‘জীবন ও বৃক্ষ' প্রবন্ধের ‘বৃক্ষের সাধনা' একই সূত্রে গাঁথা।”- মন্তব্যটি সম্পর্কে আমি একমত পোষণ করি।

নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকলে জীবনের প্রকৃত সত্য উপলব্ধি করা যায় না। প্রকৃত সত্য জানতে চাইলে ব্যক্তিকে পরোপকারী এবং নিবেদিতপ্রাণ হতে হয়। মানুষকে ভালোবেসে মানবকল্যাণে কাজ করে সার্থকতার পথে অগ্রসর হতে হয়।

উদ্দীপকের শহীদুল পরোপকারী মনোভাবসম্পন্ন মানুষ। সে ডাক্তার হয়ে শহরে বিলাসী জীবন না কাটিয়ে নিজের গ্রামে চলে আসে। নিজের গ্রামের সাধারণ মানুষকে সেবা দান করাই তার উদ্দেশ্য। সে এলাকায় দাতব্য চিকিৎসালয় প্রতিষ্ঠা করে মানুষের সেবা করে জীবনের সার্থকতা লাভ করতে চেয়েছে।

‘জীবন ও বৃক্ষ' প্রবন্ধে লেখক দেখিয়েছেন বৃক্ষের বিকাশ, পরিপূর্ণতা ও সার্থকতার পেছনে রয়েছে তার নীরব সাধনা। অন্যকে দান করার মাঝে রয়েছে তার পরিপূর্ণ তৃপ্তি ও সার্থকতা। পরোপকার করে বৃক্ষ হয়ে ওঠে সার্থকতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। উদ্দীপকের শহীদুলও পরোপকারকে নিজের জীবনের সাধনা হিসেবে গ্রহণ করেছে। সুতরাং বলা যায়, শহীদুলের ব্রত এবং ‘জীবন ও বৃক্ষ' প্রবন্ধের বৃক্ষের সাধনা একই সূত্রে গাঁথা।